ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনের কানে সমস্যা আছে, এ কারণে ভিডিওতে নুসরাতকে বার বার একই প্রশ্ন করেছেন বলে জামিন আবেদনের শুনানিকালে দাবি করেছেন তার আইনজীবী আহসান উল্লাহ।
মঙ্গলবার (৯ জুলাই) ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের জামিন আবেদনের শুনানিকালে বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে এমন তথ্য জানান তার আইনজীবী আহসান উল্লাহ। পরে আদালত আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ করে দেন।
শুনানির শুরুতে ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আহসান উল্লাহ বলেন, উনার (ওসি মোয়াজ্জেমের) বিরুদ্ধে যে মামলা হয়েছে তাতে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন নয় যে, তাকে জামিন দেওয়া যাবে না। তিনি জামিনযোগ্য মামলায় আছেন। এছাড়া তার বয়স হয়েছে, হার্টেও সমস্যা আছে।
তখন আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী আইনজীবীকে প্রশ্ন করেন, আপনি কি ভিডিওটির (নুসরাতের যে ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছিল) কথাগুলো শুনেছেন?
জবাবে আইনজীবী বলেন, শুনেছি। এজহারে হুবহু লেখাও আছে। তার প্রশ্নে কোনো ভুল নাই। তাছাড়া ওসি মোয়াজ্জেমেরে কান খারাপ। কানে সমস্যা আছে। উনার কানের চিকিৎসা চলছে। এ কারণে বার বার প্রশ্ন করেছেন।
তখন বিচারক বলেন, কানে কম শুনলে তিনি ওসি থাকেন কেমনে?
এ সময় ওসি মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলেন, তিনি কোনো অপরাধ করেননি। তার কাছ থেকে ভিডিওটি নিয়ে একজন সাংবাদিক তা ভাইরাল করে দিয়েছে।
সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে এ আইনজীবী বলেন, সাংবাদিকরা তো এখন তেলাপিয়া মাছের মত। তখন যদি ভিডিও না করে মামলা নিত তাহলে সাংবাদিকদের কেউ কেউ প্রশ্ন করত কত টাকা খেয়ে প্রিন্সিপালের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।
এ সময় বিচারক বলেন, এর পেছনে সাংবাদিকরা যদি শুরু থেকে লেগে থাকতেন তাহলে এই ঘটনা (নুসরাতের গায়ে আগুন দেওয়া) ঘটত না।
বেঞ্চের কনিষ্ঠ বিচারক বলেন, সাংবাদিকরা সমাজের দর্পন। তারা না থাকলে সমাজের এইসব ঘটনা এভাবে প্রকাশ পেত না।
তখন মোয়াজ্জেমের আইনজীবী শর্ষের মধ্যে ভূত আছে বলতে বলতে শুনানি শেষ করেন।
এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দাড়িঁয়ে বলেন, এটি একটি বার্নিং ইস্যু। নুসরাতের বক্তব্য ভিডিও করেছেন আবার ভাইরালও করেছেন। উনাকে (মোয়াজ্জেম) জামিন দেওয়া হলে সমাজে ম্যাসেজটা কী যাবে?
তখন জ্যেষ্ঠ বিচারক জানতে চান, মোয়াজ্জেম হোসেন কাস্টডিতে আছেন কিনা? থাকলে কতদিন ধরে আছেন। মাস খানেক ধরে আছেন বলে জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল আদালতকে জানান।
মোয়াজ্জেম হোসেনের শারীরিক অবস্থা জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, তার শারীর খারাপ করলে জেল কর্তৃপক্ষ দেখবেন। দণ্ডিত হওয়ার অগে আসামিদের কী চিকিৎসা দেওয়া হবে সে ব্যপারে বিভিন্ন ডিভিশন আছে।
মামলাটি কী পর্যায়ে আছে বিচারক তা জানতে চাইলে মাহবুবে আলম বলেন, আদালত অভিযোগ আমলে নিয়েছে। আগামীকাল অভিযোগ গঠনের শুনানি।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, এই ভিডিওতে অশ্লীলতা আছে। এটা করে ভাইরাল করে দেওয়া হয়েছে। একজন পুলিশ অফিসারের এমন দায়িত্বহীন কাজ মেনে নেওয়া যায় না। একজন পুলিশ অফিসার এমন প্রশ্ন করে? এসব প্রশ্ন করা কতটা ঠিক? আবার অনুমতি ছাড়া ভিডিও করে!
বিচারক মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী তখন বলেন, কিছু কিছু ওসি-ডিসি আছেন যারা নিজেদের জমিদার মনে করেন। সবার কথা বলছি না, কিছু কিছু ওসি-ডিসি অছেন। অন্যান্য দেশেও যে নেই তা নয়।
নুসরাত কেন থানায় গিয়েছিল-এমন প্রশ্নের জবাবে আদালতেকে মাহবুবে আলম বলেন, হয়ত এফআইআর বা অভিযোগ করতে গিয়েছিল। ওসির কাছে ডায়রি থাকে। কোনো ডিউটি অফিসার সে সময় যদি না থাকে তাহলে সে নোট নিবে যে, অমুক এসেছিল এই অভিযোগ নিয়ে। তা না করে মেয়েটাকে এসব অবান্তর প্রশ্ন করা হল। মজা করল, ভিডিও করল, তারপর সেটা ভাইরালও করে দিল। সে বলতে পারত তোমার বক্তব্যের লিখিত দিয়ে যাও বা লিখিত নিয়ে আস।
বিচারক মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আরও দেখলাম মামলা হওয়ার পরও পুলিশ কিছু করছে না। তখন যদি প্রোটেকশন দিত বা অ্যাকশন নিত তাহলে হয়ত এই ঘটনা ঘটত না।
বিচারপতি আরও বলেন, দায়িত্ব বা ক্ষমতা থাকার পরও সে দায়িত্ব পালন না করার কারণে যদি কোনো দুর্ঘটনা বা অপরাধ ঘটে তবে তার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ওই ব্যক্তিও সমান দায়ী।
অ্যাটর্নি জেনারেল তখন বলেন, আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীতে যারা আছেন তাদের এরকম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
এ সময় মোয়াজ্জেমের আইনজীবী আবারও বলেন, মোয়াজ্জেম হোসেন খুবই দায়িত্বশীল পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি যে ভিডিওটি করেছেন, তাতে কোনো ভালগার প্রশ্ন নেই। সে তার মা, ভাই ও একজন নারী পুলিশের উপস্থিতিতে বক্তব্য দিয়েছে। ওসি তাকে মা সম্বোধন করেছে।
ভিডিও রেকর্ড নিয়ে এক পর্যায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারক মোয়াজ্জেমের আইনজীবীকে প্রশ্ন রাখেন, সাধারণত এমনটা হয়? এসব প্রশ্ন করে থাকে পুলিশ? সব যদি পুলিশই করবে তবে তাহলে আদালত কী করবে?
তারপরও মোয়াজ্জেমের আইনজীবী বলতে থাকেন, পুলিশকে হেয় করার জন্যই এরকম উদ্ভট একটি মামলা করা হয়েছে।
পরে আদালত আবেদনটি খারিজ করতে চাইলে মোয়াজ্জেমের আইনজীবী নট প্রেস রিজেক্ট (উত্থাপিত হয়নি মর্মে খারিজ) চান। আদালত আবেদনটি উত্থাপিত হয়নি বলে খারিজ করে দেন।